ফেনি নদীর বুকে একটি ছোট্ট চরে দু’সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খোলা আকাশের নীচে আছেন একজন মহিলা। চোখের আন্দাজে বয়স তিরিশের কোঠায়।
ফেনি ত্রিপুরার দক্ষিনের জায়গা সাব্রুমের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ভারত ও বাংলাদেশ-র সীমানা হয়ে।
যেখানে ওই মহিলা আছেন, নদী এখনও হেঁটে পার হওয়া যাচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হচ্ছে বলে, হচ্ছেও অল্প-সল্প । বৃষ্টি টানা হলে ফেনি ভরাট হয়ে এই চর ডুবে যেতে পারে। ঝুঁকিতেই আছেন তিনি।
চরটি বাংলাদেশের দিক থেকে তুলনায় কাছে। সেদিক থেকে তাকে খাবার,ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
মহিলা এভাবে নদীর চরে একা, খোলা আকাশের নীচে কেন ! বৃষ্টিতে ভিজছেন, চরের বালুতেই শুচ্ছেন, অথচ সেখান থেকে দু’দিকেই ঘরবাড়ি দেখা যায় । নাগালেই সব।
একদিকে সাব্রুম , অন্যদিকে রামগড়।
মানুষটি এভাবেই একা, কারণ মানুষের সমাজ দায়িত্ব নিচ্ছে না। তার কাছে কোনও জবরদস্ত নথি নেই, যা দিয়ে তার নাগরিকত্ব প্রমাণ হয়। তিনি কোন দেশের !
ভারতীয় অংশে বিএসএফ বিজ্ঞাপণ দিয়ে তার পরিচয় চেয়েছে, এখনও পাওয়া যায়নি । খবর দিলে , পুরস্কার দেয়া হবে।
নিরাপত্তার কাজে যুক্ত এক আধিকারিক বলেছেন, বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর তরফে বলা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশী নাগরিক না।
আরেকজন বললেন, আপনারা তার সাথে ‘হিন্দি’-তে বলছেন না কেন , বলে এক বর্ডার গার্ডস অব বাংলাদেশের এক সদস্য মন্তব্য করেছেন। ইঙ্গিত তিনি ভারতীয়, আর ভারতের অফিসিয়াল কম্যুনিকেসনের একটি ভাষা ‘হিন্দি’ । হিন্দি সেরকম একটি ভাষা হলেও, সেই সীমান্ত লাগোয়া সাব্রুমের অংশটি বাঙালি অধ্যুষিত। আর হিন্দি সিনেমা ও সিরিয়াল বাংলাদেশেও যথেষ্ট জনপ্রিয়, অনেক বাংলাদেশের মানুষই হিন্দি পাকা জানেন।
মহিলা নিজে বাংলাই বলেন। উচ্চারণের নমুনায় অনেকে মনে করছেন, তিনি ঢাকাইয়া, মানে ঢাকার মানুষ । ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী।
মহিলা এদিক-সেদিক করেন, ঠিক কখন তিনি ‘জিরো লাইন’ আর আর কখন নন, সেটা বলা যায় না।
ত্রিপুরায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ৮৫৭ কিলোমিটার জুড়ে। এখানে জিরো-লাইন’র এপাশ-ওপাশই দুই দেশ, নির্দিষ্ট নো-ম্যানস ল্যান্ড নেই।
গতকাল সকালের দিকে বেশ বৃষ্টি এল। বাংলাদেশের দিক থেকে কয়েকজন এসে তাকে ছাতা দিয়ে নিয়ে গেলেন নদীর পাড়ে। বৃষ্টি কমে আসতেই আবার সেই মহিলা ভাঙা একটি ছাতা নিয়ে নেমে এলেন নদী বেয়ে চরে।
সংবাদ সংস্থা আইএএনএস লিখেছে, “ বাংলাদেশি নাগরিক হওয়া সত্বেও , বিজিবি আধিকারিকরা তাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি না” বলে এক বিএসএফ আধিকারিক মন্তব্য করেছেন।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সীমান্ত এলাকার কয়েকজন ভারতীয় নাগরিককে কথা লিখেছে। তারা বলেছেন, তারা দেখেছেন, বিজিবি কিছু বাংলাদেশিকে লেলিয়ে দিচ্ছে মহিলাকে ভারতের দিকে পাঠানোর জন্য। এপ্রিলের ২ তারিখ দুপুর বেলার দিকে এই ঘটনা। একই রকম কথা কাছাকাছি একাধিক জায়গা থেকে শোনা গেছে। দুপুরে একবার মহিলাকে বাংলাদেশের দিক থেকে লাঠি-সোটা দেখিয়ে তাড়ানো হলেও, বিএসএফ তাকে আসতে দেয়নি তখন।
আরেক জন বলেছেন, রাতে চেঁচামেচি শুনে বাইরে এসে দেখেন, বিজিবি এবং বিএসএফ, টর্চ ফেলছে, মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন চরের মাঝখানে।
গ্রামের কেউ কেউ মহিলার সাথে কথা বলেছেন, তার কথা শুনে তাদের মনে হয়েছে, তিনি মানসিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তিনি বিচ্ছিন্নভাবে ‘মিরপুর’ জায়গার নাম বলেছেন, । তিনি ‘ফারুক’ নামে কারো কথা বলেছেন, ফারুক অন্য মহিলাকে বিয়ে করায় তার মন ভেঙে গেছে।
বিএসএফ সূত্র বলছে, তারা বিজিবিকে এসব কথা জানিয়েছেন, তবে বিজিবি তাকে বাংলাদেশের নাগরিক বলে মানতে নারাজ।
ত্রিপুরা পুলিশের এক অফিসার বলেছেন, তারা বহু জায়গায় খোঁজ করেছেন, কিন্তু মহিলার পরিচয় পাননি। তার বক্তব্য, এই মহিলাকে কেউ আগে দেখেছেন বলে মনে করতে পারেনি।
সাব্রুম থেকেই ‘মানসিকভাবে স্বাভাবিক নন’ , এমন দু’জনকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
অনেকেই দাবি করেছেন, বাংলাদেশের দিক থেকে এমন মানুষদের এদিকে ঠেলে দেয়া হয়।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে এখনও বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক চিকিৎসায় আছেন। কিছুদিন আগেই একজন এখানে চিকিৎসা পেয়ে ভাল হয়ে ফিরে গেছেন। তিনি কী করে এখানে এসে পড়েছিলেন, কেউ জানেন না। প্রায় আট বছর তিনি ছিলেন এখানে।
বাংলাদেশের একটি খবরের কাগজ, দৈনিক জনকন্ঠ সাব্রুমের বিষয়টি নিয়ে ১২ এপ্রিল লিখেছে,” পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি ॥ দফায় দফায় বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠকেও কোন সুরাহা না হওয়ায় খাগড়াছড়ির রামগড় ও ত্রিপুরার সাব্রুম সীমান্তে ফেনী নদীর বালুর চরে গত ৯দিন ধরে আটকে থাকা মানসিক ভারসাম্যহীন সেই নারী মানবেতর জীবন যাপন করছে। সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডে আটকেপড়া এ নারীর পরিচয় জানতে ইতোমধ্যে বিজিবি-বিএসএফ উভয় দেশের সংবাদ মাধ্যমে সন্ধান চাই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এদিকে পতাকা বৈঠকে মানসিক ভারসাম্যহীন নারীটি ভারত থেকে বাংলাদেশে নেমে এসেছে ছবি ও ভিডিওতে এমন প্রমাণ থাকলেও তা মানতে নারাজ বিএসএফ।“
মহিলা নাগরিক যে দেশেরই হন, তাকে কি মানুষের আশ্রয় দেয়া যায় না, অথবা নাগরিকত্ব যতক্ষণ বোঝা না যাচ্ছে , ততক্ষণ আশ্রয় দেয়া যাবে না, অন্তত এই কোভিড ওয়ান নাইন সময়ে ! পরিস্কার কোনও কথা পাওয়া যায়নি।
মানুষ হান্টার-গেদারার থেকে একদিন বসতি করা শিখেছে। ফসল ফলাতে পেরেছে। জঙ্গুলে অবস্থা থেকে ‘সভ্য’ হয়েছে।
যেদিন মানুষ জঙ্গুলে ছিল , সেদিন এমন ‘সীমানা’ ছিল না। জিরো-লাইন ধারনাটাই ছিল না। সেদিনও কি মানুষ এমনই আরেকজন মানুষকে ফেলে রাখত নদীর চরে , একা !
( মহিলা ছাতা নিয়ে আসছেন, এই ভিডিও ১৭ এপ্রিলের। মহিলার বাকী ছবি , ভিডিও ২ এপ্রিলের পর বিভিন্ন দিনের বিএসএফ ডিআইজি জামিল আহমেদের ভিডিও এই মাসের প্রথম দিকের।)
( আগরতলা,ত্রিপুরা )