তারপর

সবৈ , সবৈ ! এবং সবৈ , সবৈ !

By thepongkor

May 05, 2020

‘সবৈ’,’সবৈ’ , দূর থেকে এই ডাক শুনেই বলে দেয়া যায় হাতে সরু কোদালে লম্বা হাতল, কাঁধে ফেলে চলেছেন বাবুল মিঁঞা। যারা চেনেন , তারা জানেন ‘সবৈ’ , মানে সাফাই । বাবুলের সিগ্নেচার কল।  বাড়ি বাড়ি জল নিকাশি ড্রেন পরিস্কার করেন। আগাছা কেটে দেন।  দৈনিক হাজিরার কর্মী । দিনমজুর।

 

আগরতলার বড়জলায় কাঠের মিলের কাছাকাছি কোথাও বাড়ি। কৃষ্ণনগরের অলি-গলিতে ঘোরেন কাজের আশায়। বহুদিন ধরই এই কাজ করছেন। এই প্রতিবেদকই তাকে রাস্তায় রাস্তায় দেখছেন অন্তত আট বছর। লকডাউন পিরিয়ডে তাকে দেখা যায়নি। সোমবার সকালে  দেখা গেল। ‘সবৈ’ ডাক মৃদু। প্রতিবেদক কোনও কারণ ছাড়াই জানালায় মুখ বাড়িয়ে, চোখে চোখ পড়তেই বাবুল মিঞা রাস্তা থেকে  দোতালার দিকে মুখ করে বললেন, ‘ কাজ নাই। কিছু দেন।’

বাবুল মিঁঞা কাজ চেয়ে থাকেন, তবে কোনোদিনও তাকে এরকম বলতে শোনা যায়নি। অন্তত এই প্রতিবেদক শোনেননি। পথে-ঘাটে দেখা হয়েছে পথ চলতি যেমন চোখে পড়ে থাকে, প্রত্যক্ষ পরিচয়ও নেই। অনেক বছর আগে, অন্তত পাঁচ বছর আগে একদিন বাড়ির আগাছা পরিস্কার করলেও, সেদিন বাবুল মিঁঞা গেট ধরে যখন বের হচ্ছিলেন, তখন এই প্রতিবেদক ঘরে ঢুকছেন। তাছাড়া আর এত কাছাকাছিও বোধহয় দেখা হয়নি ।

বাবুল মিঁঞার কথায়, গরীব মানুষ , কাজ নেই, সামান্য কিছু দিন।আজ বেরিয়ে দেখলাম, কেউ কাজও দিচ্ছেন না, বলছেন , ‘ তুমি এখন আইও না, পরে, পরে আইও’। স্বাভাবিকই, লকডাউন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্যই। অন্যের বাড়ি যাওয়া যায় না। কেউ গেলে অন্যজন স্বাভাবিক স্বাগত নাও জানাতে পারেন, সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সেটাই করার কথা।

সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বাঁচতে বাবুলকে আজ সাহায্য চাইতে হয়েছে। বাবুল বলেছেন, “ দুই টাকার চাল আমি পাই না, আমারে ইতা দিসে না।“ ‘কোনও সরকারি সাহায্য পাই্সি না অখনও।“

কী সরকারি সাহায্য বাবুল চান !এরকম কত বাবুল আছেন ! চলেছেন রাস্তায়!

অদক্ষ এই শ্রমিকদের ‘সবৈ’ কোথায় বিক্রি হবে !কে নেবে তাদের পরিপূর্ণ দায়িত্ব !

 

দীপালি দেব বাড়ি বাড়ি ঠিকা কাজ করেন। এপ্রিলে টাকা পেয়েছেন, লকডাউনের জন্য কাজে আসেননি। লকডাউনের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে, তবে কিছু কিছু ছাড় আছে তিনি শুনেছেন। ঠিক কী ধরনের ছাড় পরিস্কার জানেন না। এসেছেন কাজ করতে। কিন্তু বাড়িতে ঢুকবেন কী ! কাজে কি আজ থেকেই লেগে যেতে পারবেন! বাড়ির গেট থেকে ডেকে বের করলেন দিদিকে। দিদি বললেন, আর কয়দিন পরে এসো। এই দিদি তবু এখনি না করেনি। তবে গেল মাসের মাইনে কি পাবেন ! প্রশ্ন রয়েই গেল, আমতা আমতা করে বললেন, সামান্য কিছু টাকা দেবন কি গত মাসের ? দু’একদিন পরে এসে নিয়ে যেও ! টাকা দেবেন যে দিদি, সেই দিদিরও কাজ গেছে মার্চের শেষ দিনে। তিনি বলেছেন, তিনি দেবেন!

সব দীপালি টাকা পাবেন কিনা গত মাসের, সব দিদিও দিতে পারবেন কিনা ! এইসব প্রশ্ন , বা সামাজিক সুরক্ষার উত্তর, পরিস্কার জানা নেই, অন্তত সাধারণের জানা নেই। উত্তর জানানো থিওরি আছে, সেই থিওরি প্রয়োগে নেই !

 

কবে হবে ?

 

 

এই সঙ্কটে ৪০ কোটি মানুষ আরও দরিদ্রতায় জড়িয়ে পড়বেন। চলতি লকডাউন এই  সব শ্রমিকদের বিশেষ সঙ্কটে ঠেলে দিয়েছে,”  রাষ্ট্রসংঘের লেবার অর্গানাইসেন’র একটি  রিপোর্ট বলছে।

রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা রিপোর্টে বলেছে, ভারতেই পৃথিবীর ৯০ শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিক থাকেন। কাজ কমে যাওয়া , রোজগার হারানো, ইত্যাদির ঝুঁকি আছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে ,অসংগঠিত ক্ষেত্রে  কোটি কোটি মানুষ ইতোমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন। আরও প্রায় কুড়ি কোটি মানুষের রোজগার নিয়ে ঝুঁকির মুখে।

বিশ্বে সাড়ে বারকোটি শ্রমিক মারাত্বক ঝুঁকিতে আছেন। মজুরি কমে যাওয়া, কাজের সময় কমে যাওয়া, ইত্যাদি সমস্যায় পড়তে হবে। অনেক শ্রমিকই কম মজুরি ও কম দক্ষতার কাজ করেন, তাদের আরও সমস্যা বাড়বে। হঠাৎআরও আয় কমে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।

আইএলও ডিরেক্টর গাই রাইডার বলেছেন,” আমাদের দ্রুত, একসাথে পদক্ষেপ নিতে হবে। সঠিক, জরুরি ব্যবস্থাই বাঁচা ও ধ্বংসের মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।”

একটি অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়লে, তা সারা বিশ্বে প্রভাব ফেলবে। ৭৫ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।