নিঃসঙ্গ জোনাকি

নিঃসঙ্গ জোনাকি

মানিক ধর’র গল্প, নিঃসঙ্গ জোনাকি ।

মানিক ধর লেখা-লেখি করছেন অন্তত  সাড়ে তিন দশক ধরে। গল্পকার হিসেবে আঙুল-গোনা সংখ্যায় তিনি নেই, অথবা অপিরিচিত। কারণ এক, তিন দশকের লেখার হিসাব ক্যালেন্ডারের হিসেবে। কারণ দুই, ম্যাকানিকের কাজ করতে করতে ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা,  লোকতাকে সুপারভাইজারি করে, শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিকারিক। কারণ তিন, সেসব পাহাড়ে তিনি চড়তে অনভ্যস্ত, যেখানে পাশের ঘরের প্রাইভেসি কলিং-বেলে ঝুলে থাকে, ও ছাপাখানায়  একপোয়া   ‘  ঁ  ‘-র নির্লজ্জতা প্রুফরিডিং ঠিক করে দেয়। 

মানিক ধর  কেমন লেখেন-টেখেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে ! কী লিখলেন, সেটাই মন্তব্য-কোঠার উপপাদ্য। 

 

এই পাহাড়ে এর আগে আর কখনো আসা হয়নি। এখানে পাহাড় খুব একটা উঁচু নয়।চারদিক শুধুই সবুজ আর সবুজ। লাল মাটির পাহাড়। ঢেউ খেলানো আরো অগুন্তি ছোট-বড় টিলা। উপরে কিছুটা সমতল আর কিছু ঢালু জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছে ট্যুরিস্ট কটেজ।বাঁশ-বেতের ঘর। পাকা মেঝে। এটাচড্ ল্যাট্রিন-বাথরুম। সামনে পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে ঝুল বারান্দা। আদিম- মনোরম প্রকৃতির মধ্যে সমস্ত আধুনিক ব্যাবস্থাপনা। বাঁশের কারুকাজ চারদিকে। খাওয়া-দাওয়ার জন্যে রয়েছে আলাদা কিচেন। অর্ডার অনুযায়ী ঘরে ঘরে দিয়ে যায়। বাহারি নানা রং-এর ফুল রাস্তার দু’পাশে। গোটা পাহাড়েই ফুলের রাজত্ব। তবে এখানে ফুল আর ঝোপগুলো সুন্দর করে সাজানো। গাড়ি চলে আসে একদম উপরে।ট্যুরিস্ট অফিসে। সেখান থেকে লজের স্থানীয় লোকেরাই মালপত্র নিয়ে আসে কটেজে। রাবার গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি আসবাবপত্র। যেন আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। সাদা ধবধবে ডবল খাটের নরম বিছানা। বসার জন্যে কাঠ-বাঁশের সোফাসেট। কটেজের বাইরে নানা রকমের পাখি কত কথা কার সাথে যে বলে চলছে কে জানে!আর ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি। দূরে – একটু দূরে ছোট্ট রুপোলী রং-এর ঝরনার জল বয়ে চলছে তিরতির করে।

শান্তনু এখানে এসেছে আজই। দুপুরে। শহর থেকে মাত্র ঘন্টা তিনেকের রাস্তা। বছর বিশেকের হাসিখুশি মুখের ছেলেটা – যে তাকে কটেজে মালপত্রসহ নিয়ে এসেছিল,দুপুরে সেই খাবার দিয়ে যায়। গরম ভাত,আলু ভাজা, মাছের ঝোল। সঙ্গে শুটকি মাছের চাটনি। এত সুন্দর আর সরল আতিথেয়তায় পরিবেশন করা খাবার – শেষ কবে খেয়েছিল মনে করতে পারছেনা সে। ছেলেটা স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায়ের। শক্তপোক্ত গড়নের ফর্সা রং। নাম উচাই মগ। তার ডিউটি মোট তিনটে কটেজে।এছাড়াও আরো এরকম কটেজ রয়ে গেছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। উচাই ছাড়াও আরো এটেনডেন্ট রয়েছে বাকি কটেজগুলোর জন্যে। উচাই জানালো হাঁটাপথে একটু দূরে অদ্ভূত এক বনবীথি যার পাশেই রয়েছে মস্ত জলা। ইচ্ছে করলে বোটিং,রোয়িং সবই করা যায়।

বিকেলের নরম রোদে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। উুঁচু-নিচু রাস্তা। জানা-অজানা কত যে বৃক্ষকূল! এক একটার বয়সও যে কত – তা ওরাই বলতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে একটু পরেই অসাধারণ সুন্দর সাজানো এক বাগানে এসে পড়লো। দু’দিকে গাছের সারির মাঝখানে পায়ে চলা পথ। গাছগুলো রাস্তাকে যেন চাঁদোয়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। অজস্র ফুল বিছানো এ পথে পা ফেলতে গোটা শরীরে শিহরণ জেগে ওঠে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। গন্ধে মাতাল চারদিক।শান্তনুর মনে হচ্ছিল এ পথে অনন্তকাল চলা যায়!

বনতল যেখানে শেষ – তার সঙ্গেই বিশাল বড় লেক। উচাই এই জলার কথাই বলেছিল। উপরে ছন দিয়ে ছোট ছোট গোল করা চারদিক খোলা বসার জায়গা লেকের পাশে। ঘাটে অনেকগুলো বোট। কোনটা মোটর চালিত,আবার কতগুলো প্যাডেল দিয়ে। এখানে অনেক লোক।বেশিরভাগই বাইরে থেকে এসেছে। লেকের আর এক পাড়ে যাওয়ার জন্যে বাঁকানো সু্ন্দর কাঠের সেতু। শান্তনু পার ঘেঁষে হাঁটতে থাকে।অনেকেই বোট নিয়ে লেকে মজা করছে। একটা ক্যাফেটেরিয়াও পেয়ে গেল। বেশ ভিড়। যখন অপেক্ষা করছে চা-এর জন্যে মাঝবয়সী এক মহিলা তার দিকে একনজরে তাকিয়ে। মুখে একটু অবাক হওয়া হাসি।

চা হাতে নিয়ে গোলঘরে বসে শান্তনুরও মনে হল এ মুখ তার খুব চেনা। আনমনে চা-এ চুমুক দিতে দিতে মনে করার চেষ্টা করল। মহিলাও তাকিয়ে আছে তার দিকে। কোনভাবেই চেনা-জানা কারোর সঙ্গে মেলাতে পারছে না। বহু বছর তো সে এখানে ছিলও না। পুরনো আত্মীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধব অনেকের সঙ্গেই তার এখনো যোগাযোগ হয়ে উঠেনি। ফর্সা দোহারা চেহারা। গোল মুখে যেন কৌতুক লেগে আছে।দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে শান্তনু। পড়ন্ত বেলায় রাঙ্গা আলোয় তাকে যেন আরো রহস্যময়ী করে তুলছে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ছুটোছুটি করে চলছে। কেউ এসে মহিলাকে হাত ধরে টানল। এবার ফিরছে তারা। তারপরও পেছন ফিরে তার দিকে বারে বারেই তাকাচ্ছে।সঙ্গীদলের কাউকে কিছু বলছে। তার সম্পর্কে কী! অশান্ত হয়ে উঠল সে।কেন মনে পড়ছে না!

এ বয়সেও শান্তনু যথেষ্ট সুপুরুষ। চুলে পাক ধরেছে ঠিকই। কিন্তু ঘন চুল আর লম্বা চওড়া শরীরে গায়ের রং – অনেকের মাঝ থেকেও চেনা যায়। পড়তে গেলে চশমা লাগে। তা ছাড়া দূরের সব কিছুই স্পষ্ট দেখতে পায়। ধীরেধীরে লেক নির্জন হয়ে পড়ছে। ক্যাফেটেরিয়া থেকে আরো একবার চা নিল। তাদেরও বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। অক্টোবরের শেষ। লেকের একদিকে সূর্য্য ডুবছে আর অন্যদিকে আস্ত গোল চাঁদ বনের ভেতর থেকে ভেসে উঠছে। উঠতে ইচ্ছে করছিল না। লেকের ঠান্ডা হাওয়া তার অস্থির মনকে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিল। ক্যাফেটেরিয়ার ছেলেটা বলল বেশীক্ষণ এখানে বসে থাকা ঠিক নয়। বনের অনেক পশুরা চাঁদনি রাতে লেকে জল খেতে আসে।

ফেরার পথে কিছুটা চাঁদের মায়াবী আলোয়,কিছুটা আবছা আঁধারে কটেজে ফিরল। কিন্তু মনে শুধু ঐ খানিক দেখা দুর্জ্ঞেয় দুরতিক্রম্য মহিলার মুখ। যে মুখ স্মৃতিতে ফিকে হয়ে দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে যায়। বেশ ঠান্ডা পড়েছে পাহাড়ে। একটা শাল চাদর জড়িয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। চাঁদের আলোর বন্যা পাহাড়জুড়ে। অদ্ভূত নিঃশব্দ। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার গুঞ্জন আর মাঝেমাঝে দূর থেকে শেয়ালের একরোল। আস্তে আস্তে মাথা থেকে মহিলার মুখ সরছে। প্রকৃতিই তাকে আবারো নিমগ্নতায় ডুবিয়ে দিল। অপরূপ আপন ঐশ্বর্য্যে ভরা এত সু্ন্দর জায়গায় কেন আগে এল না – তাই আফশোস হচ্ছে।

অবশ্য এই পাহাড় কেন – ষাটোর্ধ জীবনে ক’জায়গায়ই বা যেতে পেরেছে! এ পর্যন্ত শুধু দায়িত্ব আর কর্তব্য করে করেই তো এতটা পথ পাড়ি দেয়া। চাকরি করার সময়ে দেশের বিভিন্ন শহরে মাঝে মাঝে যেতে হতো। তবে তা বেড়ানো ছিল না। চাকরির নানা রকমের কাজ মাথায় নিয়েই যাওয়া-আসা। বেড়ানোর শখ ছিল কী কখনো! অতীতের দিকে তাকায় শান্তনু। নাঃ। সে রকম সামর্থ্যও ছিল না,শখের স্বপ্ন দেখাও যেন বারণ। খুব ছোট্টবেলা থেকেই যার সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধন – তা হলো অভাব আর দারিদ্র।ওপার বাংলা থেকে আসা বাবা, এদেশে তাদের শেকড় গড়ে তুলতেই প্রাণান্তকর অবস্থা। শান্তনুর বাবা মফস্বল স্কুলে একটা শিক্ষকতার কাজ পেলেও বিশাল বড় সংসারের দায়িত্ব মাথার উপর পড়ে। কাকা-পিসি আর ঠাম্মা সহ দুবেলা খাওয়া জোটানোই বড় ব্যাপার। কাকা-পিসিদের লেখা পড়ার সময় তখন। পিসিদের বিয়ের পর শান্তনুর বাবা বিয়ে করেন। জন্ম হয় শান্তনু আর তার চার ভাই বোনের। সামান্য মাইনে আর প্রাইভেট টিউশন – শান্তনুর মনে পড়ে কী অসম্ভব পরিশ্রম তার বাবা করতেন! সে সকাল থেকে রাত। শহরে ভাড়া বাড়িতে তার ঠাকুমা সহ এতগুলো মানুষ! তার মা-র মুখে কোনদিন বিরক্তির ছাপও খুঁজে পায়নি। ততদিনে কাকারা পড়াশোনা শেষ করে চাকরি জুটিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। কাজের সুবাদে আলাদা হলেও কাকা-পিসিরা শান্তনুর বাবাকে শুধু দাদা হিসেবে নয় – পিতার মর্যাদায় শ্রদ্ধা করত।

পড়াশোনায় বরাবরই মেধাবী শান্তনু। হায়ার সেকেন্ডারিতে বেশ ভাল রেজাল্ট করার পর সহপাঠীরা যখন ডাক্তারি বা ইঞ্জিনীয়ারিং-এ ভর্তি হল, শান্তনু অনার্স নিয়ে কলেজে। কাকারা চেয়েছিল শান্তনু যে কোন কোর্স করুক – কিন্তু নিজেই রাজী হল না। তার শুধু বাবার মুখটাই চোখে ভাসত। কোনরকমে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যদি একটা চাকরি জোটানো যায় – তবেই না বাবা একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারেন। তাছাড়া ছোট ভাই-বোনেদের পড়াশোনার দায়িত্বও রয়েছে। মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার এত সময় কোথায় তার কাছে!

কিন্তু হল না।সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমে ঐ বছরেই শান্তনুর বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার বলেছিল হার্টের অবস্থা খারাপ। পরিশ্রম কমাতে হবে।অনেকটা আচমকাই খুব বেশি কষ্ট না পেয়ে চিরবিশ্রামের দেশে চলে গেলেন।

এত বড় ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়লো গোটা সংসারটাই। কাকা-পিসিরা ভরসা যোগালেও নিজেদের সংসার গুছিয়ে খুব বেশি কিছু করা সম্ভব ছিলনা। শান্তনুর মা-ই পাখির ডানার মত সবাইকে আগলে সামান্য পেনশনের উপর ভর করে চালাতে শুরু করেন। মা-র বড় ভরসা শান্তনু। সে দাঁড়াতে পারলে বাকি ভাই-বোনরা পায়ের নীচে শক্ত জমি খুঁজে পাবে। কলেজের ফাঁকেফাঁকে টিউশনি শুরু করল। অল্পদিনেই তার চাহিদা বেড়ে যায়। সংসারে মা-র হাতে তখন কিছু দিতে পারছে। এই করে কলেজ শেষ হলো।

চাকরিও তার হঠাৎ করেই হয়ে যায়। ও এন জি সি-তে। মেধা আর দক্ষতায় তরতর করে উপরে।মাইনেও প্রচুর। শহরেই জায়গা কিনে বাড়ি করা – মা-ভাই- বোনদের মুখে খুশির ঝলক। একটাই দুুঃখ – বাবা শুধু কষ্ট করে করেই চলে গেলেন।এখন কোন অভাব নেই। ভাই-বোনরা পড়াশোনায় ভাল। দেখতেও সুশ্রী। সবার ছোট ভাই – দীপ্তনু। মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। সবাই উঠে-পড়ে লাগল শান্তনুর বিয়ের জন্যে। এত ভাল চাকরি, তাছাড়া অত্যন্ত সুদর্শন চেহারার এমন ছেলের জন্যে পাত্রীপক্ষের চাপ কম ছিল না। কিন্তু শান্তনুর একই কথা – দুই বোনের বিয়ে না দিয়ে নিজের জন্যে ভাবা অসম্ভব। তার বাবাও তো তাই করেছিলেন।শুধু তার মা-র মনে একটা আশংকা কাজ করত। বয়স তো বাড়ছে। এমন আপনভোলা ছেলের যদি পরে বিয়ে না হয় -তার অবর্তমানে কে দেখাশোনা করবে!

কয়েকটা ঘটনা পরপর ঘটল। সুন্দরী-শিক্ষিতা দুই বোনের ভাল বরে-ঘরে বিয়ে হয়ে যাবার পর শান্তনুর মা তার বাবার মতই হঠাৎ করেই চলে গেলেন। শান্তনু এবার শরীরে-মনে ভেঙ্গে পড়ল।একেবারেই একা। মাথার উপর ছাদগুলো একে একে ভেঙ্গে পড়ছে। তার বয়স ততদিনে মধ্য চল্লিশ। ছোট ভাইও মেডিকেল পাশ করে বেরিয়ে এসেছে। তার কোন কিছুই আর ভাল লাগছিল না। আর তো কোন দায়িত্ব নেই। এমন সময়েই ও এন জি সি-র বোম্বে,পরে নাম হয়েছিল মুম্বাই অফিস থেকে ডাক পড়ল। এর পর শুধু কাজ আর কাজ। শেষের বছর পনের গোটা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অফিসের কাজ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। বাড়িতেও মাঝেমধ্যে এসেছে।ততদিনে দীপ্তনুর বিয়ে হয়ে ছেলে-মেয়েও হয়ে গেছে। মায়ের ঘরটাই তার খুব পছন্দ ছিল।সামনে-পেছনে বাগান। মা-র নিজের হাতে লাগানো কিছু গাছ এখনো রয়ে গেছে। অযত্নে আগাছায় বাগান নষ্ট হয়ে পড়ছে। দোতলা বাড়ির উপরতলায় থাকে দীপ্তনুরা। নীচে একটা ঘরে তার চেম্বার। ছোট বোনদের বাড়িতেও যায়।কাকারা কেউই নেই। থাকার মধ্যে তার চেয়ে বছর তিনেকের বড় ছোট পিসিই রয়ে গেছেন। ঐ পিসির সঙ্গে তার বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশী।

মোবাইল টিপে দেখল – রাত বেশি হয়নি।আটটাও বাজেনি। কিন্তু মনে হয় গভীর সুপ্তিমগ্ন এই সময়। শুধু সেই জেগে আছে। একটু চা পেলে ভাল হত। আবার উচাইকে ডাকা। থাক।ঘরে যেতে ভাল লাগছিল না। বাইরে ঠাণ্ডা পড়লেও এরকম জোৎস্না মাখা রাত শান্তনুকে আবিষ্ট করে তুলছিল। এখানে মোবাইলের টাওয়ার নেই। ফলে ফোনের যন্ত্রণাও নেই। তাকে ফোন করার লোকও কমে গেছে। আর সেই বা কাকে করবে! ফিরে গেল আবার সেই অতীতে।

পাহাড়ের ট্যুরিস্ট লজের কথা ছোট পিসিই বলেছিল। মুম্বাই-এর পাট চুকিয়ে পাকাপোক্তভাবে নিজের জন্মভূমি, নিজের বাড়িতে থাকবে। বাড়ি শুধু নয় – ভাই-বোন আর মায়ের স্মৃতিতে গন্ধে মাখা এক অনুভূতি। মায়ের ঘরেই নিজের জায়গা করে নিয়েছে। সেই বিছানায় শুয়ে মুখ গুঁজে সম্ভবত মা-র বুকের গন্ধটাই পেতে চায়। আসলে সব অতীত, সব অনুভূতিরও এক সীমারেখা থাকে। শান্তনু ভাবে। বাকি ভাই-বোনরা কেন তার মত ভাবে না – তা নিয়ে আগে আক্ষেপ থাকলেও এখন বুঝতে পারে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব বৃত্ত তৈরি হয়ে গেছে।পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করা মাঝেমাঝে খারাপ লাগে না। কিন্তু সেগুলোকে আগলে রাখলে বর্তমান-ভবিষ্যত দুইই ডুবতে বসবে। অন্তত সংসারী যারা – তাদের কাছে এ এক বিলাসিতা।

কয়েকদিন আগের কথা। রাতে খেতে বসেছে সবাই মিলে। দোতলায় দীপ্তনুদের খাবার ঘরে।ওর স্ত্রী মিতালি বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে।ঐ রাতে একটু বেশিই আন্তরিকতা দেখছিল শান্তনু। খেতে খেতেই মিতালি একটু আব্দারের সুরে বলল – দাদা,আপনাকে একটা কথা বলার ছিল। আপনার ছোট ভাই তো কিছুই বুঝেনা।সংসার ঘর-বাড়ি তো আমাকেই দেখাশোনা করতে হয়। ছেলে-মেয়ে সামলে এত বড় বাড়ি নজর রাখাও যায় না। আমি আপনাদের বোনেদের সঙ্গেও কথা বলেছি। এখন আপনি রাজি হলে পাকা কথা বলা যায়।

শান্তনু কখনোই গম্ভীর নয়। কিন্তু প্রয়োজনের বাইরে কথাও বলে না। ফলে ভাই-বোন এমনকি চাকরির জায়গাতেও দেখেছে সবাই তাকে সমীহ করে অথবা এড়িয়ে চলে। শান্তনু জিজ্ঞাসু চোখে ছোট ভাই-এর দিকে তাকাল। দীপ্তনুর মাথা প্রায় খাওয়ার প্লেটের দিকে নুয়ে পড়ছে। টেবিলে ওরা তিনজন। তাদের ছেলে-মেয়েরা ঘরে চলে গেছে। মিতালিকে কী বলতে চায় জানতে চাইল।

– দাদা,বলছিলাম কি, এখন তো এতবড় বাড়ি কেউই রাখেনা। আগাছায় চারদিক ভরে যায়।তাছাড়া বাড়িটাও পুরনো হয়ে গেছে। আমার বাবা বলছিলেন – যদি সবটা জায়গা প্রোমোটারকে দিয়ে দিই তাহলে সুন্দর ফ্ল্যাট বাড়ি হতে পারে। আমাদের জন্যে দু’টো তলা কোন খরচা ছাড়াই তৈরি হয়ে যায়। আপনার ভাইকে আমি ব্যাপারটা বুঝাতে পারছিনা। শুধুই বলে দাদার তৈরি বাড়ি। এখানে নাকি আমাদের কিছু বলার অধিকার নেই। আপনিই বলুন – আমার বাবা কী খারাপ পরামর্শ দিয়েছে?

শেষের দিকের কথাগুলো শান্তনুর মাথায় আর ঢুকছিল না। শুধুই ভাবছিল – এত কষ্ট করে তৈরি বাড়িটা পুরনো হয়ে গেল! মা-এর হাতে লাগানো গাছগুলো -তাও আগাছা! ভাড়া বাড়ি থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথম নিজস্ব আস্তানা!

খাওয়া শেষ হয় নি। কিন্তু আর খেতে পারছিল না। কোন কথা না বলে বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে গিয়ে শুনতে পেল দীপ্তনু আর মিতালির কথা কাটাকাটি।
-দাদা কতটা দুুঃখ পেল বুঝতে পারছ! লোকটা খেতেও পারল না ভাল করে। এতটা যন্ত্রণা এখুনি না দিলেই না হত!
-তুমি তো দাদার সামনে ট্যাঁ ফোঁও কর না। কথাটা তো বলতেই হতো। তা উনি পুরনো স্মৃতি নিয়ে যদি পড়ে থাকতে চান, থাকুন। আমি পারব না। এই জংলা ভূতুড়ে বাড়িতে থাকতে।ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমার আলাদা থাকতে হবে। মিতালির গলার ঝাঁঝ বাড়ছে।

মা-র বিছানা আঁকড়ে ধরে শান্তনু সারা রাত ছটফট করল। একবার মনে হল ওরা যদি চলে যায় যাক। সে কোন অবস্থাতেই এ বাড়ি নষ্ট হতে দেবে না। আবার মনে হল মিতালি যে টাইপের -এতে দীপ্তনুর কষ্টটাই বাড়বে। মিতালির বাবা নিজেই প্রমোটার। একবার যখন এ বাড়িটাতে চোখ পড়েছে – তা না নিয়ে ছাড়বে না।বাড়ি যদিও শান্তনু করেছে কিন্তু তা তো মা-এর নামে। এ বাড়ির ওয়ারিশ তো ভাই-বোন সবাই।বাকিদের আপত্তি না থাকলে শান্তনু একা কী ই বা করবে! এখানে না ফিরে এলেই ভাল হত বলে এখন মনে হয়।

ছোটপিসি সবই জানত। তার মনের ব্যাথার জায়গাটা এ সংসারে এখন একমাত্র তিনিই জানেন। বললেন – কত করে বুঝাতে চেষ্টা করলাম,বিয়ে কর। শুনলিই না কোন কথা।আমিই বা আর কতদিন। তোকে কে এরপর দেখবে! ক’দিন একটু ঘুরে আয়। মনটা শান্ত কর। তারপর যা হয় হবে।

উচাই রাতের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাকে বললো খাবার ঢেকে রেখে যেতে। পরে খাবে। কোন কথাই শুনতে রাজি নয়। সে নিজে মোরগের মাংস রান্না করেছে। কেমন হয়েছে তা খেয়ে বলতে হবে। পাহাড়ের মানুষের মত সরলতা আর আন্তরিকতা শহরের মানুষের মধ্যে নেই কেন! শান্তনু ভাবে। সে এসেছে মাত্র আজ দুপুরে। কখন চলে যাবে আর কখনো আসবে কী না তা শান্তনুও বলতে পারে না। কিন্তু উচাই যা করে চলেছে তাতে মনে হয় কত দিনেরই না পরিচয়!

অসংখ্য পাখির কেঁচোর- মেচোরে খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। সাধারণত একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠে। আর বিছানায় থাকতে ইচ্ছে করছে না। শাল চাদর গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল।সূর্য্য তখনো ওঠেনি। পুব দিকে একটু লাল আভা। সবুজ বনভূমি একটু শিশিরে ভেজা ঘাস-পাতাগুলো যেন হীরের আলোয় দ্যুতিময়।টুপটুপ করে পাতা বেয়ে কুয়াশার জল গায়ে লাগছে। আর ভার সইতে না পেরে ফুলগুলোও ঝরে ঝরে পড়ছে।

বনবীথি যেখানে শুরু, অজস্র ফুল টুপটাপ করে ঝরছে,হাল্কা ভোরের আলোয় দেখতে পেল গতকাল বিকেলের সেই মায়াবী রমণীকে।দু’হাতে ফুল তুলে আবার ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাকে দেখে হাসল। যেন মুক্তোর ঝিলিক। এ বিশ্বের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে শান্তনুকে আহ্বান করল।বলল – এসো। তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি। জানতাম – তুমি আসবে।
বিহ্বল শান্তনুর ঘোর তখনো কাটছে না।অপরিচিতা এত আপন করে কাছে ডাকছে – সে কেন মনে করতে পারছে না! ফুলের রেণু গন্ধ মাখা শরীর কাছে নিয়ে বলল – তুমি কিন্তু একটুও বদলাও নি! একদম আগের মতোই রয়ে গেছো। আচ্ছা তুমি কী সত্যিই আমাকে চিনতে পারছ না! অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কী করে বলবে – তাকে এখনো মনে করতে পারছে না! এবার জোরে হেসে উঠল।বললো – তোমায় দোষ দিচ্ছি না। বোধহয় আমিই বদলে গেছি। আমি শ্রেয়া।

স্মৃতির সমস্ত মণিকুঠরি ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়ে অর্ধ অচেতন মনকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে তাকে ফেলে দিল বিয়াল্লিশ -তেতাল্লিশ বছর অতীতে।অষ্ফুটে উচ্চারিত হল – শ্রেয়া! কী আশ্চর্য!
আবারো হাসলো। বললো – যাক। বাঁচা গেল। যদি বলতে – না, এই নামের কাউকে চিনিই না। কী হত তবে আমার!
শান্তনুর সত্তা জুড়ে আলোড়ন চলছে। কী করে ভুলে যেতে পারল শ্রেয়াকে! তার কঠোর শুষ্ক জীবনে সেই তো একমাত্র স্বপ্ন ছিল। প্রথম আর শেষ।

কলেজে পড়াকালীন যে কয়েকটা বাড়িতে ট্যুইশন করতে যেত – শ্রেয়াদের বাড়ি ছিল তার মধ্যে একটা। শ্রেয়া তখন হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেবে। সায়েন্স গ্রুপের টিচার খুঁজছিল। কে ঠিক মনে পড়ে না – শান্তনুকে ঠিক করে দিয়েছিল। ভাল ছাত্র শান্তনুর ট্যুইশন বাজারে বেশ চাহিদা। অবস্থাপন্ন বাড়ি। সে সময়ে মোটা টাকা পাওয়া যেত। যা দিয়ে মায়ের সংসারের অনেকটাই সুরাহা হত। ভালোভাবেই এগোচ্ছিল শ্রেয়ার পড়াশোনা। কিন্তু শ্রেয়ার মনে যে সে জায়গা করে নিয়েছে – তা শান্তনু বুঝতে পারে অনেক পরে। শান্তনু সুদর্শন, সুপুরুষ। কলেজেই অনেকে যেচে সম্পর্ক করতে চেয়েছিল। সে সাড়া দেয় নি। কিন্তু শ্রেয়ার ব্যাপার অন্যরকম।আস্তে আস্তে শান্তনুও জড়িয়ে পড়ে। কয়েক বছর চলতে থাকে। দুই বাড়ির কারোর আপত্তি ছিল না তাদের সম্পর্ক নিয়ে। কিন্তু শান্তনু বোনেদের বিয়ে না দিয়ে কোন কিছু করতে রাজি নয়। মনে পড়ে শেষ একদিন এসেছিল শ্রেয়া। বিয়ে ঠিক করে ফেলছে তার মা-বাবা।শান্তনু মলিন হয়ে যায়। বলে – আমার কিছু করার নেই।আর তুমি আমার জন্যে কতদিন অপেক্ষা করবে! শ্রেয়া বলতে চেয়েছিল – অনন্তকাল। বলা হয়ে উঠেনি। বিয়ে হয়ে যায়।

সেই শ্রেয়া এতদিন পর! রোমাঞ্চ জাগে শরীরে।শ্রেয়াই কথা বলতে থাকে। কলকল ঝরনার মতো। বলে – তোমাকে একদিন না কোন একদিন ঠিকই পাবো। তা আমি জানতাম। তুমি কী এখনো গম্ভীর হয়েই থাকো?
— কই নাতো। বিড়ম্বনা কাটিয়ে শান্তনু একসাথে সব না বলা কথাগুলো বলতে যায়।
—- এসো তবে সামনে এগিয়ে যাই। আরো সুন্দর,আরো খুব সুন্দর জায়গা আছে এখানে।শ্রেয়ার গায়ে গা লাগে। শরীরে আবারো শিহরণ।
হাঁটতে হাঁটতে ওরা এসে বসল এক মস্ত বড় গাছের তলায়।পাখিরা ডাকাডাকি আর এ গাছ থেকে অন্য গাছে বা আকাশে উড়তে শুরু করেছে।
— কী অবাক করা কাণ্ড। এত বছর পর এভাবে দেখা হওয়া। মাঝখানে কতগুলো সময় কেটে গেল। শান্তনু বলছিল যেন নিজেকেই।
—- যা যাওয়ার তা গেছে। পুরনোকে ফিরিয়ে আনা কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু যা আছে তা নিয়েও তো পথ চলা যায়। কী বল! শান্তনুর চোখের দিকে তাকিয়ে শ্রেয়া হাসিমুখেই বলে চলে।
– — কিন্তু এই পড়ন্ত বেলায়! শান্তনুর গলায় সংকোচের সুর।
—- জীবন কী শুধুই ফুটন্ত সময়ের জন্যে? কৌতুকমাখা চোখে শ্রেয়া বলে।

শ্রেয়ার গা থেকে এমন এক অদ্ভূত গন্ধ বেরুচ্ছে যে গন্ধ নেবার জন্যে সে আকুল হয়ে ছিল। ঠিক বলতে পারবে না – তবে না বুঝা এই গন্ধটাই মাঝেমাঝে পেয়ে যেত। আর তখনি তার মন এক অনাস্বাদিত আনন্দে ভরে যেত। এখন মনে হচ্ছে শ্রেয়ার শরীর থেকেই এই মন-চেতনা জুড়নো সুগন্ধ।

এত ভাল করে শ্রেয়াকে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না।যে ক’বছর দুজনের সম্পর্ক ছিল মুখোমুখি বা পাশাপাশি থেকেও সম্ভ্রমের গণ্ডী কেউই পার হয় নি। সবটুকু রাখা ছিল বিয়ের পরবর্তী জীবনের জন্যে। এক অনুপম স্বর্গীয় সুষমা শ্রেয়াকে ঘিরে আছে। যত দেখছে শান্তনুর বিমুগ্ধতা বাড়ছে। ঊষার নরম আলো,চারপাশে নিঃশব্দ অথচ বাঙময় সৌন্দর্য —- স্বর্গ কী এর চেয়ে বেশী সুন্দর হয়! কী এমন হত যদি দু’জনে বিয়ে করে ফেলত! আজ নিজেকে এতটা নিঃস্ব মনে হত না। বুকের কোন এক গভীর গোপন জায়গা থেকে করুণ সুর বেজে উঠল।
—- কী ভাবছ এত! শ্রেয়া যেন তাকে ভাসিয়ে নিতে চাইছে।
— নাঃ। ভাবছি কতই না ভুল হয়ে গেল। তা কী আর ফিরে পাওয়া যাবে!
—— বললাম না পেছনে তাকাবে না।একদমই না। চলো সামনে চলো।আরো সুন্দর জায়গা রয়েছে। শ্রেয়া হাঁটতে শুরু করেছে।
—- তুমি এত সুন্দর জায়গার খোঁজ পেলে কী করে? শান্তনু পিছন থেকে শ্রেয়াকে দেখছে।
—- আমি যে এখানেই থাকি। হাসছে শ্রেয়া।ফুলের বনের মধ্যে চারদিকে কত রং-এর প্রজাপতি! চপলা কিশোরীর মত সোনালি আলোয় আর সবুজ আভায় ভেসেই চলছে।
শুধু শান্তনু স্থাণুবৎ হয়ে রইল।তারও দৌড়োতে মন চাইছে – শ্রেয়ার ডাকে এগিয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু দুই পা-ই যেন পাথর হয়ে আটকে গেছে।শেষবারের মত চেষ্টা করল শ্রেয়াকে ডাকতে, তাকে ফেলে না যেতে – ততক্ষণে অনেক দূরে বনের আরো গভীরে চলে গেল।

উচাই জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। আরো একবার এসেছিল। চা নিয়ে। কলিং বেল টিপে কোন শব্দ না পেয়ে ভেবেছিল ঘুমুচ্ছে। সামান্য ধাক্কাও দিয়েছিল। সাড়া না পেয়ে এবার জোরে জোরে ধাক্কা। ধড়মড়িয়ে উঠল শান্তনু।এই শীতের সকালেও তার সারা শরীর ঘামছে!কিন্তু ঘর ম ম করছে শ্রেয়ার গায়ের গন্ধে!

.

.

COMMENTS