স্বপ্নের তিন ঘন্টা !

স্বপ্নের তিন ঘন্টা !

নবারুন ঘোষ

“জোরে হেসে বললেন,আমি তো সব সময় ভাল থাকি। ভাল থাকাটাই আমাদের একরকমের বাধ্যতা।

………..ওই যে আপনি বলতেন, “ওদের ওখানে হারাতে হবে,  জিততে হবে…”,  তাই।”

বিকাল সাড়ে চারটা নাগাদ সরোজদা’র ফোনটা এল,  “ঠিক সাড়ে আটটায়, হোটেল  ওয়েলকাম প্যালেস’র সামনে চলে এসো। আর শোনো, তৈরি হয়ে এসো।” ফোনটা রেখে আমার মধ্যে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি, তাহলে ঘটনাটা সত্যি হতে যাচ্ছে ! একটা অদ্ভুত শিহরণ মনে ।

যাইহোক, ঠিক সাড়ে আটটায় সরোজদা’র নির্দেশ মত তৈরি হয়ে ওয়েলকাম প্যালেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সরোজদা, আর অতনু এসে হাজির।

স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সরোজদা বললেন, “অরুন্ধুতীর গান চলছে, আমরা চলে এলাম, সুমন্ত আসছে, তুমি তৈরি হয়ে এসেছ তো!”

মাথা নাড়লাম আমি! আমার হাতের দিকে তাকিয়ে,  সরোজদার এক গাল হাসি, “বুঝে গেলে?”

এই টুক-টাক কথায় মাঝেই সুমন্ত এসে গেল। এসেই তাড়া, “চলো-চলো, তোমাদের বসিয়ে দিয়ে, আমাকে আবার হলে যেতে হবে।“

ওয়েলকাম প্যালেসে’র সেই স্যুটের দরজা খুলে, প্রথমে সুমন্ত, পেছনে সরোজদা,  তারপর আমি আর অতনু, একে একে ঢুকলাম।

ঘরটা কেমন যেন আলো-আঁধারির, একটুক্ষণের মধ্যেই ঘরটা যেন হঠাৎ উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল।

আমি রোমাঞ্চিত, শিহরিত, হতবাক!  স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম,  ঠিক দেখছি তো!

লাল-খয়েরি পাঞ্জাবি, আর সাদা ট্র‍্যাক-স্যুট,  পায়ে হাওয়াই চটি। সারা ঘর উজ্জ্বল করে দাঁড়িয়ে আছেন,  আমার স্বপ্ন-পুরুষ! একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি।

পুরুষদেরও স্বপ্ন-পুরুষ থাকে!  সম্বিত ফিরল সরোজদার কথায়। “এসে গেছি, কেমন আছেন আপনি?”

জোরে হেসে বললেন,

——–আমি তো সব সময় ভাল থাকি। ভাল থাকাটাই আমাদের একরকমের বাধ্যতা।

তারপরেই সেই হাসি!

হ্যাঁ, আমি দাঁড়িয়ে আছি,  সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সামনে।

আমার শৈশবের ফেলুদা, যৌবনের ক্ষীরদা!

 

হাতের বস্তুটাকে নিয়ে ইতস্তত করছিলাম, আর বিব্রতও বটে। সহজ করে দিলেন তিনিই।

—- ওটা ওখানে রেখে দিন!

ততক্ষণে সুমন্ত বেরিয়ে গেছে।আমার কীরকম সঙ্কোচ,  ভয় লাগছিল, একটু একটু কাঁপছিল ভেতরটা। কিছুতেই জড়তা ভাঙছিল না, নির্বাক হয়ে ছিলাম।

—– আরে বসো, বসো!  সরোজ, তোমার বন্ধুদের কিন্তু আমি ‘তুমি’ করেই বলছি। বসে পড়ো তো সবাই, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কী আর বসা যায়!  গুটিয়ে-সুটিয়ে বসলাম। সরোজদা সব জায়গাতেই স্বচ্ছন্দ। যেকোনও আড্ডা জমিয়ে দেয়ায় ওস্তাদ!  নানা কথায় আস্তে আস্তে পরিবেশটা আমাদের কাছেও সহজ হয়ে উঠল। আমিও কথা বলতে শুরু করলাম। ছোটবেলা থেকেই জমিয়ে রাখা নানা কথা,  ফেলুদা থেকে শুরু করে হ-য-ব-র-ল আবৃত্তি করা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসা, আমার সব মনের কথা।

রাত গভীর হচ্ছিল, আরও খোলামেলা হচ্ছিলেন তিনি, সাহস বাড়ছিল আমারও। তার কাছ থেকে সাবলীল উত্তর পেয়ে আরও প্রশ্র‍য় পেয়ে যাচ্ছিলাম আমি। অনেকটা র‍্যাপিড ফায়ারের মতই প্রশ্ন করে চলছিলাম।

উদার মনের গভীর থেকে উত্তর দিয়ে চলছিলেন সৌমিত্রবাবু, আমার স্বপ্ন-পুরুষ।

জিজ্ঞেস করলাম, কোন্‌ ফেলুদাকে ভাল লাগে,  সোনার কেল্লার ফেলুদা,  নাকি জয় বাবা ফেলুনাথ’র ফেলুদা?

—— কঠিন হয়ে গেল যে!  তবে কী জানো, সোনার কেল্লা,  সোনার কেল্লাই!

আপনার কি মনে হয়,  সন্তোষ দত্ত ছাড়া ফেলুদা হয়?

তার মুখ থেকে হাসিটা চলে গেল।

—– সন্তোষ দত্ত’র কোনও বদলি হয় না, বিরাট মাপের অভিনেতা।  জটায়ু আর  সন্তোষ দত্ত,  সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যজিতবাবু হয়ত সন্তোষ দত্ত’র জন্যই জটায়ু চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন।

 

 

রাত আরও গভীর হচ্ছিল।  সময় চলে যাচ্ছিল দুরন্ত গতিতে, কথায় কথায় বললেন, সিনেমার অভিধানের যা কিছু আছে, তার সবটাই আছে চারুলতায়। আমার মনে হয়, সত্যজিৎ রায়ের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এটাই।

জিজ্ঞেস করলাম, তবে ‘চারুলতা’-ই আপনার অভিনীত আপনার সবচেয়ে  পছন্দের ছবি?

—— চারুলতা তো বটেই, তবে আমার কি মনে হয় জানো, অশনি সংকেত-এ আমার পার্টটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল।

সাহস বাড়ছিল আমার। বেমক্কা প্রশ্ন শুরু করলাম।

সুচিত্রা সেন, না সুপ্রিয়া দেবী?

আবার যেই ভুবন ভোলানো হাসি!

——-এই ভাবে কোনও তুলনা হয় না। দু’জনেই দু’জনের জায়গায় অদ্বিতীয়া।  মেঘে ঢাকা তারা দেখেছো?  তবে কী জানো, সাবিত্রি আমার খুব প্রিয় অভিনেত্রী।

ঘুরিয়ে আমাকেও একটা প্রশ্ন করলেন,

—— আমার কোন্ সিনেমাটা তোমার সবচেয়ে বেশি ভাল লেগেছে?

এক মুহূর্তের দেরি না করে উত্তর দিলাম, কোনি!

—–কেন?

ওই যে আপনি বলতেন, “ওদের ওখানে হারাতে হবে,  জিততে হবে…”,  তাই।

আবার সেই হাসি।

জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ করে হ-য-ব-র-ল আবৃত্তি করলেন, ক্যাসেট করলেন। বাচ্চাদের কবিতা আবৃত্তি করলেন, কোনও বিশেষ কারণ?

—– বলো কী!  বিশেষ কারণ নেই?  কী অসাধারণ সৃষ্টি! আমি বলতে চেষ্টা করেছি, তোমরা তো শুনেছো!

কথা চলছিল।  মাঝে আবার সরোজার গান, “আমি চিনি গো চিনি তোমারে,  ও গো বিদেশিনী!”

কথায় কথায় চলে গেলেন ক্রিকেটে।

ক্রিকেট নিয়েও কী গভীর প্রজ্ঞা আর পড়াশোনার ব্যাপ্তি তার!  নেভিল কার্ডাস’র বই থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিলেন অনর্গল।  কলিন স্মিথের মৃত্যু, এক গাড়িতে থেকেও গ্যারি সোবার্সের বেঁচে যাওয়া, আরও কত ঘটনা,  ছবির মত সাজিয়ে দিচ্ছিলেন আমাদের সামনে!

 

রাত তখন পৌনে বারটা।  এবার উঠতে হবে।

আগন্তুক-এ  সত্যজিৎ রায় আপনাকে নিলেন না, উৎপল দত্তকে নিলেন। মন খারাপ করেননি, আপনার প্রিয় মানিকদাকে জিজ্ঞেস করেননি, জানতে চাননি কেন নিলেন না ?

চুপ হয়ে গেলেন!

——– হ্যাঁ, শেষ ছবিটা করতে পারলাম না, ছিলাম না, দুঃখটা তো থাকবেই। তবে মানিকদাকে জিজ্ঞেস করিনি। মানিকদাকে এই প্রশ্ন করলে,  উত্তরটা কী দিতেন, তা আমি জানতাম, ” আরে!  ওটা উৎপলবাবু ছাড়া হয় না।”

আবার সেই হাসি। প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম।

আমরা তিনজনেই ওয়েলকাম প্যালেস থেকে কেউ কারও সাথে কথা না বলে যে যার মত রওয়ানা দিলাম।

মোটর বাইকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে কানে ঠান্ডা হাওয়া লাগছিল। মনে হচ্ছিল, বাতাস আমার কানে কানে বলছে, এটা কিন্তু তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চয়, বিরাট সম্পদ, যত্ন করে রেখে দিও, এই স্বপ্নের তিন ঘন্টা।

গম গম করে কানে বাজছিল, তার কন্ঠে নেভিল কার্ডাস’র বই থেকে উদ্ধৃতি,

” We remember not the scores and the results in  after years; it’s the men who remain in our minds, in our imagination.”

 

অবশ্য উল্লেখ্যঃ  ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, শ্রদ্ধেয় মানুষটির মৃত্যুর পর এই লেখাটি লিখছি বলে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, সুমন্ত চক্রবর্তীকে,  আজ থেকে পনের বছর আগে আমাকে ওই সুযোগটি তৈরি করে দেয়ার জন্য। সরোজদাকে ( চক্রবর্তী) কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট করব না, কারণ এই রকম আরও অনেক বড় মানুষের সাহচর্য পেয়েছি সরোজদার দৌলতে। আর অতনু ঘোষ,  আমাদের সেদিনের আরেক সঙ্গী ছিলেন।

বছর পনের আগে এক সন্ধ্যায় আগরতলায় দেখা হয়েছিল, তার সাথে, তাহার সাথে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’র সাথে !

 

( নবারুন ঘোষ, ছাত্র রাজনীতি করতেন। খেলা, নাটক জড়িয়ে ছিলেন এক সময়। আগরতলায় ‘অন্যমুখ’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইকনমিক্সে এম এসসি করেছেন। এলআইসিআই’র সিনিয়র ম্যানেজার পদে চাকরি করছেন। )

COMMENTS