আশির দাঙ্গার পর  কাঞ্চনপুরে  জনতে এবং তার সহকর্মীদের প্রীতিভোজ !

আশির দাঙ্গার পর  কাঞ্চনপুরে  জনতে এবং তার সহকর্মীদের প্রীতিভোজ !প্রতিকী ছবি !

 তন্ময় চক্রবর্তী

 

ঘটনাটি একজনের মুখে শোনা।  ধরে নিন, আমার মাসিমা। অ্যাকাডেমিক কাজে  তার ইন্টারভিউ  নিয়েছিলাম। কথায় কথায় উঠে এল এই কাহিনি।

কাঞ্চনপুরের ঘটনা। ১৯৮০ সালের জুন মাস,  এক সরকারি অফিসে কাজ করেন মহিলা। মিজো ভাষার মানুষ।  সবাইকে তাকে ডাকেন ‘জনতে’ নামে। কঞ্চনপুরে থাকতেন  বোনকে নিয়ে। বোনও সরকারি কাজ করেন সেখানে। তাদের বাবা অমরপুরের একটি গির্জায় পাদ্রী। দাঙ্গার সময় বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন জনতে। তখন  আজকের মতো টেলিফোন বা যোগাযোগের এত সুবিধা ছিলনা। হাতে হাতে মোবাইল বিষয়টি তখনও চিন্তায়ও আসেনি। অনেক চেষ্টা করেও বাবার কোনও খবর জানতে পারছিলেন না। কাঞ্চনপুরের বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মচারীরা একদিন জনতেকে নিয়ে হাজির হলেন বিডিও সাহেবের কাছে। সবাই মিলে বললেন, জনতের বাবার খোঁজ  বের করে দিতে হবে, যেমন করেই হোক !  বিডিও সাহেব জানালেন, তিনি চেষ্টা করবেন। ওয়্যারলেসে ম্যাসেজ পাঠালেন অমরপুরে। যে ঠিকানা দেয়া হয়েছিল গির্জার, তাও জানালেন। জনতের বাবার নাম  বলে অনুরোধ করলেন,  তিনি কেমন আছেন,  তা যেন একটু খবর নিয়ে তাড়াতাড়ি জানানো হয়।

পরের দিন অমরপুর থেকে কাঞ্চনপুরের বিডিওর কাছে খবর গেল, যে গির্জার ঠিকানা দেয়া হয়েছে, সেখানে পাদ্রী নেই। তিনি কোথায় আছেন, কেউ জানেন না !

বাবার খোঁজ না পেয়ে  বেশ ভেঙে পড়েছেন দুই বোন। সহকর্মীরা তাদের সান্তনা দিচ্ছেন। বোঝাচ্ছেন, কিছু হবে না বলে।  দু’বোনের মনে শান্তি নেই। প্রতিদিন খবরের অপেক্ষায় থাকেন। বাবার কোনও খোঁজ পাওয়া গেল কিনা, উদগ্রীব হয়ে থাকেন।

দাঙ্গার জন্য খবরের কাগজও পৌছায় না সেখানে। গাড়ি বন্ধ। ভরসা বলতে, সন্ধ্যায় রেডিওর খবর। দু’বোন অপেক্ষায় থাকেন। খবরে তো আর এমনিতে তাদের বাবার কথা বলবে না, সেটা তারা বোঝেন।  রাজ্যের অবস্থা কেমন, তা বোঝার চেষ্টা করেন। তাদের বাবার কোনও খারাপ খবর নেই তো !   কোনও জায়গায় আবার নতুন করে গণ্ডগোল শুরু হল, না অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছে, বোঝার চেষ্টা করেন।

পরিচিত লোকজন প্রতিদিন এসে তাদের খবর নেন। তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। দাঙ্গায় ত্রিপুরার বিভিন্ন জায়গা ক্ষতবিক্ষত হলেও কাঞ্চনপুরে তার কোন আঁচড় পড়েনি। কাঞ্চনপুর ছিল শান্ত। এমনকী গোটা উত্তর জেলাই  তার কোনও খারাপ  প্রভাব নেই। আপাত শান্ত।  উত্তেজনা ছিল জেলার বিভিন্ন জায়গায়,  তা কোনওদিন মানুষের শুভ বোধকে হারিয়ে মাথা চাড়া দিতে পারেনি।

কয়েকদিন পর, জনতে এবং তার বোন ঠিক করলেন, তারা দু’জন  অমরপুরে যাবেন। বাবাকে খুঁজতে আনতে হবে।  অফিসের  সহকর্মীদের   জানালেন এই কথা।  সহকর্মীরা কিছুতেই তাদের একলা ছাড়তে রাজি নন। তারা ঘটনা জানালেন, ধর্মনগরের এসডিওর কাছে। তখন মহকুমা আধিকারিককে   এসডিও বলা হত। ধর্মনগরের এসডিও জানালেন, তিনি চেষ্টা করে দেখছেন।  কিছুতেই জনতে বা তার বোন যেন কাঞ্চনপুর ছেড়ে  না যান। অন্তত জাতীয় সড়কের দিকে না যান। সবাই মিলে আবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে জনতেকে আটকান, তিনি যেন কোথাও না যান।

এসডিও বিভিন্ন জায়গায় ম্যাসেজ পাঠালেন। কয়েকদিন পর রিপোর্ট এল। পাওয়া গেছে জনতের বাবাকে। শান্তিরবাজারে। তিনি অমরপুর থেকে পালিয়ে চলে গেছেন শান্তিরবাজারে। জঙ্গলের পথে হেঁটে শান্তিরবাজারে এক পরিচিতের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। দাঙ্গায় বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল অমরপুরও।

দাঙ্গা থামার পর জনতের বাবা কাঞ্চনপুরে যান মেয়েদের কাছে।

১৯৮০ সালের ১৫ আগস্ট। দাঙ্গার আগুন নিভে গেছে ত্রিপুরায়।  তার ছাই উড়ছে বিভিন্ন জায়গায়।

কাঞ্চনপুরের সরকারি   কোয়ার্টার কমপ্লেক্সে, এবং তার লাগোয়া বিভিন্ন বাড়িতে ভাড়া থাকতেন বিভিন্ন জায়গা থেকে সেখানে যাওয়া সরকারি কর্মচারীরা।  তার পাশেই একটা মাঠ। সেই মাঠে ১৫ আগস্ট রাতে খাবারের ব্যবস্থা। তাবু খাটিয়ে খাবারের আয়োজন হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মচারীরা নিমন্ত্রিত। জনতে এবং তার বোন খাওয়াচ্ছেন। সবাইকে। বাবাকে খুঁজে পেতে সবাই যেভাবে সাহায্য করেছেন, তারই একটা ছোট্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

 

কাঞ্চনপুর, ত্রিপুরার উত্তরদিকের একটি মহকুমা। কাঞ্চনপুরেই বিখ্যাত জম্পুই হিলস। কমলালেবুর জন্য সবাই এই নাম জানেন। আর আছে, আরও বিখ্যাত ‘ব্যাম্বু ড্যান্স’। সেই পাহাড়ের ঢালে মেঘ হেঁটে হেঁটে আসে বারান্দায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এখানে ভেঙে পড়েছিল যুদ্ধ বিমান। এই পাহাড়েই ত্রিপুরার সবচেয়ে উঁচু চূড়া।   মিজোরামের সাথে অনেকটা সীমান্ত এই মহকুমার। ত্রিপুরা উপজাতি স্বশাসিত জেলা পরিষদে অনুপজাতি  আসন এখানেই। অনেকগুলি ক্যাম্পে প্রায় তেইশ বছর ধরে মিজোরাম থেকে আসা হাজার হাজার রিয়াঙ ( ব্রু) উদ্বাস্তুরা আছেন। তাদের পুনর্বাসন দেয়া নিয়ে আপত্তি তুলে এক সপ্তাহের বেশি বনধ হয়ে গেল কাঞ্চনপুরে।

(তন্ময় চক্রবর্তী  সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত দেড় দশকের বেশি সময় ।  একটি গবেষণামূলক কাজ করছেন, সেই কাজ করতে করতেই পাথরের খোঁজে গিয়ে হীরাও পেয়ে যাচ্ছেন। সেরকমই একটি কাহিনি এই ।)

COMMENTS