ত্রিপুরায় চাকরি হারানো শিক্ষকদের আন্দোলনের সাত দিন। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ আধিকারিককে চিঠি।

ত্রিপুরায় চাকরি হারানো শিক্ষকদের আন্দোলনের সাত দিন। নিরাপত্তার জন্য পুলিশ আধিকারিককে চিঠি।

ত্রিপুরায় ‘১০৩২৩’ শিক্ষকরা চাকরি ফিরে পাওয়া, এবং মৃতসাথীদের পরিবারের রোজগারের ব্যবস্থার দাবিতে লাগাতর অবস্থান করছেন। সাতদিনে পড়েছে আন্দোলন।রাজধানী আগরতলার সিটি সেন্টার চত্বরে চলছে আন্দোলন।
এই শিক্ষকদের তিন সংগঠনের যৌথ মঞ্চের ডাকে ধর্ণা চলছে।

শিল্পী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ছাত্র, ডাক্তার, বেকার, সমাজের নানা অংশের মানুষ সংহতি জানিয়ে পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন চাকরি হারানো, অভাবে থাকা শিক্ষকদের।
অবস্থান মঞ্চেই রাখা ছিল, তাদের ভালবেসে দিয়ে যাওয়া চাল, আলু, সব্জির বস্তা। বিস্কুটের প্যাকেট। কম্বল। জল।

হাতে মাটির ব্যাঙ্ক, গণ অবস্থান মঞ্চে ছোট্ট এক শিশু। শিক্ষকদের এই ব্যাঙ্কে জমানো টাকা দিয়ে গেছে।

“যখন ছাত্র ছিলাম এই শিক্ষকরা হৃদয় উজার করে দিয়েছেন আমাদের।
এখন সময় তাদের সম্মান বজায় রাখার, তাদের ফিরিয়ে দেয়ার। আমার কোনও শিক্ষকই ‘অযোগ্য’ ছিলেন না শিক্ষকতার জন্য।”
এক ডাক্তার আন্দোলনে থাকা ‘১০৩২৩’ শিক্ষকদের নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন।

সরকারি চাকরি না পাওয়া ডাক্তারদের একটি সংগঠন সামাজিক মাধ্যমে লিখেছে, ” ওনারাও মানুষ এবং বহুদিন ধরে ত্রিপুরার শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ছিলেন। রাজ্যের বহু শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক এবং আরো বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিগন ওনাদেরই শ্রমের ফসল।”
তারা এই শিক্ষকদের জন্য স্বাস্থ্য শিবির করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা ও প্রাক্তন ছাত্ররা তাদের সাধ্যমত টাকা দিয়ে সাহায্য করে, তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। তাদেরই একজন, সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ত্রিপুরার মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। তারা যেন প্রতিশ্রুতি পালন করেন।
ত্রিপুরা স্বশাসিত উপজাতি জেলা পরিষদ’র সদর দফতর খুমুলুঙ থেকে ছাত্রীরা এসেছেন শিক্ষকদের আন্দোলনের সমর্থনে।
এক ছাত্রী চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না।

ছবিঃ শিক্ষকদের সংগঠনের ফেসবুক থেকে

দুইদিন আগে কিছু ছাত্র বলে গেছন, তারাও ধর্ণায় বসবেন যদি শিক্ষকদের দাবি পূরণ না করে সরকার। তাদের শিক্ষকদের পাশে থাকবেনই।

শিক্ষকরা বলছিলেন, একমাত্র ছাত্র-ছাত্রীরাই শিক্ষকের যোগ্যতার সার্টিফিকেট দিতে পারেন, তারা আমাদের অযোগ্য ভাবেন না।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এগিয়ে এসেছেন।

ছবিঃ কৌশিক দাস

এক আইনজীবী অবস্থান মঞ্চে কথা দিয়ে গেছেন, কোনও শিক্ষকের ছেলে-মেয়ের যদি পড়াশোনায় অসুবিধা হয়, তাকে ফোন করতে, তিনি পাশে দাঁড়াবেন।

সামাজের নানা স্তর থেকে মানুষ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, আবার গণ্ডগোল পাকাবার চেষ্টাও আছে।

পুলিশের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, গভীর রাতে শিক্ষকদের অবস্থান মঞ্চের সামনে চিৎকার, চেঁচামেচি, অকথ্য কথা-বার্তা,ইত্যাদি করে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা হয়েছে।
সেই সূত্রটিই বলেছে, কোথাও কোথাও শিক্ষকদের বাড়িতে হুঁশিয়ারি শোনানো হয়েছে। প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে এই অবস্থানে না যাওয়ার কথা তো বলা হচ্ছেই।

এক শিক্ষকের বাড়িতে বোমা মারা হয়েছে কয়েক দিন আগে।

আন্দোলনে থাকা শিক্ষকদের জয়েন্ট মুভমেন্ট কমিটি মহকুমা পুলিশ আধিকারিকের কাছে লিখিতভাবে জানিয়েছে, বহিরাগতদের উপদ্রবের কথা। তারা বিশেষত শিক্ষিকাদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।

 

ছবিঃ শিক্ষকদের সংগঠনের ফেসবুক থেকে

সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেয়া হয়েছিল, একটি এলাকার নাম করে বলা হয়েছে, কারা এই অবস্থানে এসেছেন, তা দেখে রাখা হয়েছ,… ” এবার বুঝবে।”

যে ছাত্ররা শিক্ষকদের জন্য এগিয়ে এসেছেন, তাদের সামাজিক মাধ্যমে উপদেশ দেয়া হচ্ছে যে এটা রাজনীতির বয়স নয়, স্কুল ইউনিফর্ম ছেড়ে যেন আসেন তারা, স্কুলের ছাত্রদের রাজনীতি মানায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

“ত্রিপুরা সরকার, তোমার প্রতিশ্রুতি পালন কর।” পোস্টার ঝোলানো সারি সারি অবস্থানের জায়গায়। মৃত সাথীদের ছবি। কাশ্মীরে মারা যাওয়া ত্রিপুরা ছেলে, বিএসএফ জওয়ান সুদীপ সরকারকে শ্রদ্ধা জানিয়েও পোস্টার আছে।

 

শয়ে শয়ে কাজ হারানো শিক্ষক-শিক্ষিকা সিটি সেন্টার চত্বরে। রাত এখানেই ঠান্ডায় কাটাচ্ছেন।রাস্তায়, ফুটপাতে, সরকারী দালানের বারান্দায় কোনোরকমে শুয়ে থাকছেন। বাড়ি ছেড়ে জেলা থেকে এসেছেন বহুজন। পাব্লিক টয়লেটে জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।
বেশ কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে নিতে হচ্ছে। আজ শঙ্কর চক্রবর্তী।

দুই মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে মা এসেছিলেন।

ছবিঃ শিক্ষকদের সংগঠনের ফেসবুক থেকে

কারও বাড়ি থেকে ফোন এসেছে, মেয়ের  বেতন দিতে হবে। একজন আরেকজনের চোখের জল মুছে দিয়ে, নিজে আড়াল করে চোখের জল লুকোচ্ছেন।
” আমাদের আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। কিছু হাতে না নিয়ে আর এই মুখ দেখাতে পারব না। কী করে কী হবে, জানি না। প্রতি মূহুর্তেই খবরের অপেক্ষা করছি। ছাত্ররা আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছেন। গর্বে বুক যেমন ফুলে যাচ্ছে, আবার লজ্জায় মনে হচ্ছে মাটিতে মিশে যাই, ছাত্ররা আমাদের জন্য খাবার আনছেন। আমাদের এই সন্তানদের এই করার ছিল! এইভাবে!” বলছিলেন এক শিক্ষক।
” অন্তত ত্রিশ হাজার টাকা প্রতিদিন দরকার। এতগুলি মানুষের খাবারেই কত খরচ। জানেন, মাত্র দশ টাকা পকেটে আছে, আমাদের এমন সাথীও আছেন এখানে। এখুনি সরকারের কিছু করা উচিৎ,” বললেন এক শিক্ষক নেতা।

” কীসের এত ইগো। কীসের এত অহংকার।কীসের পরীক্ষা, পরীক্ষা করছেন! আর কত পরীক্ষা দেব আমরা, আমাদের আর কত পরীক্ষা নেবেন! আমাদের সমস্যার সমাধান করুন। আপনাদের আমরা সোনার সিংহাসনে বসাব,” বলছিলেন এক শিক্ষিকা।

” আমরা সরকারের কাছে তিনটি উপায় প্রস্তাব করেছি। এক, ত্রিপুরা হাইকোর্টের  রায়ের ১২৭ ধারা ধরে আমাদের রক্ষা করুন, শিক্ষকতার চাকরি ফিরিয়ে দিন। দুই, সুপ্রিম কোর্টের শেষ নির্দেশিকাতেই আছে, রাজ্য সরকার ‘সোলেস’ দিতে চায়, সেটা করুন। আপনারাই তেমন জানিয়েছেন আদালতকে। তিন, বার হাজার পদে আমাদের ইন্টারভিউ দেয়া আছে,তাতে নিয়োগ দিন,” বললেন এক শিক্ষক নেতা।
” সাধারণ মানুষ আমাদের পাশে আছেন। তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারের সামান্যও সাড়া নেই। তারা আমাদের ব্যবস্থা করার কথা দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীই বলেছিলেন, দুইমাসের মধ্যে ব্যবস্থা করবেন।এই সরকার যদি আগের সরকারের করা দালান, ওভার ব্রীজের উদ্বোধন করতে পারে, তাহলে বার হাজার পদে নিয়োগ দিতে কীসের ইগো! ” বললেন এক নেত্রী।

” সরকারের স্বদিচ্ছা থাকলেই তাদের ব্যবস্থা করা সম্ভব। করা যাবেই।” গতকাল মন্তব্য করছেন মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী পুরুষোত্তম রায় বর্মন। “সরকারের কাছে অনুরোধ, এই বিষয়টাকে ইগো বানাবেন না, রাজনৈতিক লাভালাভের হিসাব করবেন না,” বলছেন তিনি। তাদের সংস্থা হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেসন নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে।

শিক্ষকদের একটি সংগঠন আবার আদালতের দরজায় কড়া নেড়েছেন।

বিজেপি ২০১৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই শিক্ষকরা রাজনৈতিক চালের শিকার বলে দাবি করে কথা দিয়েছিল, আইন মেনে, সংবিধান মেনে তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করবে। আইন সংশোধন করে ব্যবস্থা করবে। বিজেপি নেতা, আসামের মন্ত্রী ডঃ হিমন্ত বিশ্বশর্মা এও বলেছিলেন, তার কথা রেকর্ড করে রাখতে, কথা না রাখলে সেই রেকর্ড ‘ঘুমা ঘুমাকে চালানা’। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রকে নাকি তাদের বিষয় চলে গেছে।তিনি নাকি রাজ্যের রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীদের মিটিঙে ‘১০৩২৩’ শিক্ষকদের জন্য সাওয়াল করেছেন, উত্তরপূর্বের সব শিক্ষামন্ত্রীদের এই ব্যাপারে একজোট করেছেন। অভিযোগ করেছিলেন, সেখানে নাকি ত্রিপুরার শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন না। তখনও কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় ছিল, এখনও আছে। এখন ত্রিপুরায়ও বিজেপি পরিচালিত সরকার।   তখন বিপ্লব কুমার দেব, তখনকার বিজেপি’র ত্রিপুরা সভাপতি, এখন মুখ্যমন্ত্রী আইন মেনে তাদের ব্যবস্থার কথা বলেছিলেন। তাদের ভিশন ডকুমেন্টেও ছিল প্রতিশ্রুতি।

অবশ্য দুই হাজার টাকা করে সামাজিক ভাতা, ৩৪০ টাকা দৈনিক মজুরি, বছরে ৫০ হাজার সরকারি চাকরি,ঘরে রোজগার,কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জেনেটিক ডাটা বেস,ইত্যাদি প্রতিশ্রুতিও ছিল, এখনও পূরণ হয়নি, প্রায় তিন বছর হয়ে এল।

ত্রিপুরার শিক্ষামন্ত্রী নানা সময়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের বিকল্প ব্যবস্থা হচ্ছে, বেতন যা পাচ্ছিলেন, তার আশে-পাশে থাকবে, বলেছিলেন। আবার কখনও বলেছেন, তিনি বেঁচে থাকলে ব্যবস্থা কিছু একটা হবেই। একসময় আউটসোর্সিং’র কথা শুনিয়েছেন। একসময় অর্থ দফতরের পরামর্শমত বছরে দুই হাজার করে চাকরি ছাড়া হবে, সেসব চাকরির পরীক্ষায় এই শিক্ষকরা বসতে পারবেন, তাতে না হলে আউটসোর্সিং। এখন আবার সেই স্যাণ্ড থেকে সরে গেছেন।
এখন বলা হচ্ছে, অন্য বেকারদের সাথে চাকরির পরীক্ষায় বসতে। আন্দোলন না করে চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে।
আন্দোলনে থাকা শিক্ষকরা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

COMMENTS