ত্রিপুরার আকাশে বৃহস্পতি-শনি ! উদয়পুরে তোলা, ১৭ ডিসেম্বরের ছবি। লেখকই তুলেছেন এটি।
অয়ন সাহা
গোটা পৃথিবী একুশের অপেক্ষা করছে। দুহাজার একুশ নয়, একুশে ডিসেম্বরের। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্যেই সৌরজগতের দুই বিশাল গ্রহ, বৃহস্পতি ও শনিকে খুব কাছাকাছি দেখা যাবে। এতটাই কাছে যে খালি চোখে দুটিকে একটি তারা বলে ভুল হবে। শেষবার এই দুই গ্রহ এতটা কাছাকাছি এসেছিল ১৬২৩ সালের ১৬ জুলাই, প্রায় চারশ বছর আগে। তার আগে ১২২৬ সালে। এবারের পর আবার এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ মানুষ পাবেন ২০৮০ সালের ২৫ মার্চ। ২১ ডিসেম্বর আকাশে বৃহস্পতি ও শনির কৌণিক দূরত্ব হবে দশমিক এক ডিগ্রি। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, পূর্নিমার চাঁদের আকার দশমিক পাঁচ ডিগ্রি। তার মানে, পূর্নিমার চাঁদের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যতটা দূরে, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ দূরত্বে গ্রহ দুটিকে দেখা যাবে। যদিও তাদের প্রকৃত দূরত্ব থাকবে সাড়ে তিয়াত্তর কোটি কিলমিটার ! সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে বৃহস্পতির সময় লাগে বার বছরের সামান্য কম সময়। শনির লাগে সাড়ে ঊনত্রিশ বছর। তাই প্রায় উনিশ বছর পর পর গ্রহ দুটি আকাশে খুব কাছাকাছি দেখা যায়। এই ঘটনাকে বলে ‘সংযোগ’ ( Conjunction) । মনে রাখতে হবে, প্রতি সংযোগে গ্রহ দুটির দূরত্ব বিভিন্ন হয়।
কোথায়, কখন, কীভাবে দেখতে হবে এই মহাজাগতিক মহামিলন ? একুশে ডিসেম্বর ত্রিপুরায় সূর্যাস্ত হবে চারটা বেজে ত্রিশ মিনিটে। সূর্যাস্তের পর পরই দক্ষিণ-পশ্চিম আকাশে তাকালে একটি বড় তারার মত দেখা যাবে গ্রহ দুটিকে, যদিও তারার মত তারা মিটমিট করবে না। টেলিস্কোপ বা শক্তিশালী বাইনোকুলারে দেখা যাবে অভূতপূর্ব দৃশ্য। ত্রিপুরা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি উদয়পুরের নজরুল গ্রন্থাগারের ছাদ থেকে শক্তিশালী কম্পুটার নিয়ন্ত্রিত টেলিস্কোপে এই বিরল মহাজাগতিক দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা করেছে। একুশ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা ছয়টা আটান্ন মিনিটে ত্রিপুরার আকাশে গ্রহ দুটি অস্ত যাবে। বৃহস্পতি আর শনির এই মহাসংযোগ দেখতে দেখতে মনে প্রশ্ন আসতে পারে, বৃহস্পতি কি কখনও শনি গ্রহের সামনে এসে তাকে আড়াল করে দিতে পারে ! উত্তর, পারে। শনি শেষবার বৃহস্পতির আড়ালে ঢাকা পড়েছিল প্রায় নয় হাজার বছর আগে, ৬৮৫৫ খৃষ্টপূর্বাব্দের ১ জুন। এমন বিরলেরও বিরল ঘটনা আবার হবে প্রায় ৫৫০০ বছর পর, ৭৫৪১ খৃষ্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি। শুধু তাই নয়, সেই বছরে দুবার দেখা যাবে এই দৃশ্য, একই বছরে দুইবার । দ্বিতীয়টি হবে ১৭ জুন।
একুশে ডিসেম্বর দিনটি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্য কারণেও গুরুত্বপূর্ন। এই দিনেই পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণায়ন ( Winter Solstice) শুরু হবে। শীতের শুরু। বছরের সবচেয়ে ছোট দিন, সবচেয়ে বড় রাত। ঠিক কতটা বড়, কতটা ছোট ? একুশে ডিসেম্বর ত্রিপুরায় দিনের দৈর্ঘ দশ ঘন্টা চল্লিশ মিনিট, রাত তের ঘন্টা ষোল মিনিটের। শয্যাপ্রিয় লোকদের জন্য সুখের দিন ! এদিনে পৃথিবীর উত্তর মেরুবিন্দু সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে হেলে থাকে, আর দক্ষিণ মেরুবিন্দুটি সূর্যের দিকে বেশি হেলে থাকে। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক থেকে এই দিনে উত্তর গোলার্ধে শীতের এবং দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মের শুরু। মনে রাখতে হবে, পৃথিবী্র অক্ষটি সাড়ে তেইশ ডিগ্রি কোণে হেলে থাকে। অনেকেরই একটি বদ্ধমূল ধারণা, শীতে বোধহয় পৃথিবী সূর্য থেকে দূরে চলে যায়, আর গ্রীষ্মে খুব কাছে চলে আসে। ধারণাটি সঠিক নয়। পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে, উত্তর গোলার্ধে তখন কনকনে শীত। সবচেয়ে দূরে থাকে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে। উত্তর গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মকাল। বছরের দীর্ঘতম রাতের ঘটনা প্রবাহ এখানেই শেষ নয়। ১৭ থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখা যাবে উল্কা বৃষ্টি। উত্তর আকাশের লঘু সপ্তর্ষি মন্ডল ( Ursha Minor) থেকে ঘন্টায় প্রায় দশটি করে উল্কা নেমে আসছে, দেখ যাবে। তারামন্ডলটির নাম থেকেই এই উল্কাবৃষ্টির পোষাকি নাম, লঘু সপ্তর্ষি মন্ডল’র উল্কাবৃষ্টি (Ursids)। অন্ধকার কোনও জায়গা থেকে রাত সাড়ে নয়টার পর এই উল্কাপাত খালি চোখেই দেখা যাবে।
বৃহস্পতি-শনি’র মহামিলন এবারই প্রথম পৃথিবীর মানুষ টেলিস্কোপ দিয়ে দেখবেন। চারশ বছর আগে শেষবার যখন এমনটা হয়েছিল, তখন বেঁচে ছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলে। তখন সেটা হল, যখন আকাশে দিনের আলো। তার আগের বার সেই ১২২৬ সালে, সে সময় টেলিস্কোপ ছিলই না।
২০২০ সালটি সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য দুঃখ আর উৎকন্ঠায় কেটেছে। ২০২১ আসার আগে আকাশের জ্যোতিষ্করা যেন আমাদের জন্য আনন্দ আয়োজন করবে ২১ তারিখ। আয়োজনে সামিল হতে ভুলবেন না ।
অয়ন সাহা দীর্ঘদিন ধরে আকাশ-চর্চা করছেন। নতুন ছেলে-মেয়েদের হাতে ধরে আকাশ চেনান টেলিস্কোপে চোখ রেখে। কিছুদিন আগে ‘নাসা’র একটি প্রকল্পে, পৃথিবীর দিকে কোনও বড় উল্কাপিণ্ড, গ্রহানু, ইত্যাদি আসছে কিনা, সেসব চিহ্নিত করার কাজ করেছেন। ত্রিপুরার উদয়পুরে থাকেন।
COMMENTS